নদীভাঙ্গন ও প্রাকৃতিক দূর্যোগে চরম ক্ষতিগ্রস্থ লবণাক্ত উপকূলীয় উপজেলা খুলনার কয়রা। যেখানে রয়েছে সুপেয় পানির মারাত্মক সমস্যা। নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প ও অগ্রাধিকারমূলক গ্রামীণ পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ১৮৮ পিস ৩ হাজার লিটারের ট্যাংক বিতরণ করা হয়। যা চাহিদার তুলনায় অতি নগণ্য। তারপরও অস্বচ্ছলদের অগ্রাধিকার না দিয়ে অধিকাংশ ট্যাংক বিতরণ করা হয়েছে স্বচ্ছল ও চাকরীজীবীদের মধ্যে। এছাড়া অর্থ লেনদেনসহ স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগও উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুলনার কয়রা উপজেলায় বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এলাকাভিত্তিক একান্ত আস্থাভাজন ব্যক্তিরা এলাকার বিত্তবান ও স্বচ্ছল চাকরীজীবীদের কাছ থেকে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিয়ে তাদেরকে পানির ট্যাংক এর ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।
মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের সাবেক এক চেয়ারম্যানের ছেলে সাইফুদ্দিন মোল্লা। তার মা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা। বাড়িতে পাকা বিল্ডিং রয়েছে, তিনিও এই পানির ট্যাংক পেয়েছেন।
মহেশ্বরীপুর গ্রামের মোঃ হাফিজুর রহমানও পেয়েছেন একটি ট্যাংক। পাইকগাছার শাহপুরস্থ একটি ইটের ভাটায় তার শেয়ার, মাছের ব্যবসাও করেন তিনি। তার পাকা গৃহসহ জমিও রয়েছে বেশ।
মহারাজপুর ইউনিয়নের দেবদাস রায়ও পেয়েছেন একটি ট্যাংক। তিনি মহারাজপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। বাড়িতে পাকা দালান ও বেশ জমিও রয়েছে তার। একই ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের প্রভাবশালী এক মৎস্য ব্যবসায়িও একটি ট্যাংক পেয়েছেন। তার স্থানীয় মৎস্য আড়তে কমিশন এজেন্টের ব্যবসা। দালানসহ বাড়িও রয়েছে তার। ইউপি নির্বাচনে সদস্য প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
এছাড়া নিজের ৫/৬ বিঘা জমিতে মৎস্য ঘের করা অরুণ মন্ডল, মৎস্য ব্যবসায়ি ও চাষী আব্দুল মালেকসহ স্বচ্ছল আব্দুল গফুর ঢালী, পিযুস রায়, ইউপি চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন আক্তারুল ইসলামও পেয়েছেন ট্যাংক। এছাড়া কয়রার প্রতিটি ইউনিয়নে ট্যাংক বিতরণ নিয়ে অস্বচ্ছলদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
বাগালী ইউনিয়নে কিছু নিম্নবিত্ত পাওয়া গেলেও ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে ট্যাংক নিতে হয়েছে বলে ট্যাংক প্রাপ্ত কয়েকজন অভিযোগ করেছেন। এছাড়া অনেকে টাকা দিয়েও এখনো ট্যাংক পাননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, অধিকাংশ ট্যাংক বিতরণ করা হয়েছে চাকরীজীবী, প্রভাবশালী স্বচ্ছল রাজনীতিক নেতা-কর্মী ও অর্থবিত্তশালীদের মধ্যে। কেউ রাজনীতিক যোগসূত্রে আবার কেউ অর্থের বিনিময়ে কিংবা জনপ্রতিনিধিদের ঘনিষ্ঠ হয়ে অথবা আত্মীয় সূত্রে এসব ট্যাংক পাচ্ছেন।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থ বছরে এ এলাকার দরিদ্র মানুষের নিরাপদ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য সমগ্র দেশের নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প ও অগ্রাধিকারমূলক গ্রামীণ পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় ১৮৮ টি ট্যাংক উপজেলা থেকে বিতরণ করা হয়েছে। পরিপত্র অনুযায়ী বরাদ্দকৃত ট্যাংকির ৫০ শতাংশের তালিকা দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। বাকী ৫০ শতাংশ বন্টন করা হয় উপজেলা ওয়াটসন কমিটির মাধ্যমে। যে কমিটির সভাপতি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সহ-সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সদস্য সচিব উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী। তবে এই কমিটির জন্য বরাদ্দকৃত অধিকাংশই দেয়া হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের তালিকা অনুযায়ি।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মিঠুন রায় বলেন, জনপ্রতিনিধিরা তৃণমুল থেকে যে তালিকা আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন সেই তালিকা অনুযায়ি ট্যাংক বিতরণ করা হয়েছে। তালিকা যাচাই বাছাই করা হয়েছে কিনা, প্রশ্ন করলে তিনি জানান অফিসিয়ালি যাচাই বাছাই করা হয়নি। আর টাকা নেয়ার বিষয়ে বলেন, টাকার বিনিময় হয় কিনা আমার জানা নাই।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এই ট্যাংক গুলোর বেশির ভাগ আমাদের সংসদ সদস্য দেন। আর বাকিটা ইউনিয়নে ভাগ হয়ে যায়। সব গরীব মানুষ পাচ্ছে সেটাও না। পানির কষ্টতো, যার কারণে গরীব-ধনী দেখা হয়নি। আর অর্থ লেনদেনের অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য মোঃ আক্তারুজ্জান বাবু খুলনা গেজেটকে বলেন, কয়রার প্রত্যেকটি বাড়িতে পানির সমস্যা রয়েছে। সে তুলনায় ট্যাংক সরবরাহ খুবই নগণ্য। স্পেশাল বরাদ্দের জন্য চেষ্টা করছি। যাদের কেনার সামর্থ্য নেই তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেয়া হচ্ছে। অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে, এমনটিই জানালেন তিনি।
খুলনা গেজেট/এনএম